ইউসুফ আরমান

রমজানের মহত্ব ও গুরুত্ব। অপরিসীম হলেও রমজানের মর্যাদা আমাদের দেশে চরমভাবে ভুলুন্ঠিত। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবেও কোন উদ্যোগ নেই।
মাহে রমজান আসলেই দ্রব্যমূল্যে আরব ব্যবসায়ীরা সংযমী আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি পাগলা ঘোড়ার ন্যায় ছুটতে থাকে। যেন এ মাসে ইবাদত বন্দেগীর জন্য পূন্য হাসিলের কোন সীমারেখা নেই, তেমনি আকাশ ছোঁয়া মূল্য ছাড়িয়ে গেলেও কারোর কিছুই করার থাকবে না? দ্রব্যমূল্য দায়িত্ব কার বেশি? আমরা কেমন মুসলমান? আল্লাহর বান্দাদের জন্য এভাবে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ইবাদত-উপাসনাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়? কোথায় আছে এমন জুলুম? কেনই বা দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিলেন, আছেন, অনেক সময় তারা চোখ বুঁজে থাকেন। সিন্ডিকেট নামক দৈত্যকে কেন প্রশ্রয় দেন? কি জবাব আছে সৃষ্টিকর্তা মনিবের কাছে? এদেশের তো সিংহভাগ ব্যবসায়ী মুসলিম, মুসলিম হয়ে পবিত্র মাসে জালিমের মত অনৈতিক কাজ করা কতটুকু উচিত? শুধু মুসলমানরা নন, রমজান মাস এলে অমুসলিম ভাই-বোনেরাও কষ্টে পতিত হন, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর আগুন মূল্যের ফলে। আমাদেরকে সকলের কথা ভাবতে হবে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে-যাতে আল্লাহর রহমতের মাসে প্রত্যেক মানুষই রহমত ও করুণা ধারায় সিক্ত হতে পারেন।
সৌদি আরবে পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে মূল্য ছাড় দেওয়ার রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামেন আরব ব্যবসায়ীরা। চাউল, চিনি, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নেমে আসে অর্ধেকে । সৌদি সরকার ভোক্তা অধিকারে কঠোর নজরদারি করে থাকে। সাধারণত সৌদি আরবে সব ধরনের পণ্যসামগ্রী আমদানী নির্ভর। আমদানিকৃত পণ্যের ক্রয়মূল্যের ওপর পরিবহন খরচ, বিদ্যুৎ, ইমারত ভাড়া, সেবামূল্য সংযোজন করে শতকরা ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ লাভে বিক্রি করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। ইচ্ছা করলেই কোনো ব্যবসায়ী পণ্যদ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করতে পারেন না। প্রতিটি পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশিকা মেনে চলতে হয়। প্রতিটি পণ্যের মেয়াদের ওপর নির্ভর করে লভ্যাংশ নির্ধারণ। রমজানের সময় সাধারণত ক্রেতাদের একটি বাড়তি খরচের ধাক্কা বইতে হয়। তাই ভোক্তাদের কথা চিন্তা করে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানি মূল্যের সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ যুক্ত করা হয় না। অন্যান্য পণ্য যেহেতু আগের মূল্যেই থাকে, সে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে মুনাফা অর্জন না করলেও লোকসান গুনতে হয় না ব্যবসায়ীদের। এতে যেমন লাভবান হন ক্রেতা, তেমনি ব্যবসায়ীরাও পবিত্র এ মাসে ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করতে পেরে পরিতৃপ্তি অনুভব করেন।
রমজান আমাদের কাছে প্রতি বছর নাজাতের বার্তা নিয়ে, আসে জীবনকে পরিশুদ্ধ করার জন্য, পাপমুক্ত করার জন্য এবং আল্লাহকে ভয় করে চলার জন্য। তাই বলা যায়, রমজান আত্মশুদ্ধি, নৈতিক প্রশিক্ষণ ও আত্ম গঠনের মাস হল রমজান।
আল কুরআনে বলা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
“হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর। যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো বা তোমরা যাতে খোদাভীতি অর্জন করতে পারো।”
রমজান মাসকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধিতে জনজীবন চরম দুর্বিষহ করে তুলেছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী রমজানকে সামনে রেখে একদিকে ইবাদত বন্দেগী করে অপরদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করে। এমন ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই মুল্য বৃদ্ধি ও খাদ্যে ভেজাল বন্ধ করতে হবে। মাহে রমজানের সম্মানে সব ধরণের গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে ও রাখতে সরকারকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতির কারণে দেশের সর্বত্র দুর্নীতি মহামারি আকার ধারণ করেছে। দেশের সর্বত্র চলছে দুর্নীতি আর দুঃশাসনের মহা প্রতিযোগিতা। সুইপার-কুলি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি পর্যন্ত সকলেই কোন না কোনভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িত। সুদ, ঘুষ ও দুর্নীতির ভয়াবহ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাধি। এই ব্যাধি জাতি হিসেবে আমাদেরকে বিশ্বের সামনে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। এসকল অন্যায় ও খোদাদ্রোহীতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্মূল করতে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব সরকারের। তাছাড়াও সাহরী ও ইফতারে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের নীতি-নৈতিকতা, জবাবদিহিতা ও ইসলাম সম্মত জনসেবামূলক ভূমিকা মাহে রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে কিন্তু তা না করে বরং উল্টো বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এমন পরিস্থিতি দেশের সীমিত আয়ের মানুষের জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। আর আবর দেশ গুলোতে যখন এ আত্মশুদ্ধি আর কৃচ্ছ্রসাধনের বার্তা নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে প্রতি বছর উপস্থিত হয় পবিত্র সাহারুর রামাদান বা মাহে রমজান মাস। সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার এই মাসে আরব উপত্যকায় পরিলক্ষিত হয় কৃচ্ছ্রসাধনের সুন্দর দৃষ্টান্ত। চাল-চলন, আহার থেকে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সংযম পালন করা হয়।

লেখক পরিচিতি
ইউসুফ আরমান
কলামিস্ট ও সাহ্যিতিক
জেদ্দা, সৌদি আরব